করোনা মহামারীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় সব খাতই সংকটে। তবে বিশ্ববাজারে তুলা ও কেমিক্যালের দাম বাড়তে থাকায় গভীর সংকটে পড়েছে পোশাক খাত। উৎপাদন কম হওয়ায় এক মাস ধরেই বিশ্ববাজারে তুলা ও কেমিক্যালের দাম বাড়ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরের জন্য তুলার অগ্রিম বুকিং দিলেও মে মাসের তুলনায় কেজিপ্রতি ২২ সেন্ট বেশি দিতে হচ্ছে। আর এক মাস পর তুলা পেতে হলে ২৭ সেন্ট বেশি দিতে হচ্ছে। তুলার পাশাপাশি কেমিক্যালের দাম বেড়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। করোনা মহামারীতে পোশাকের ক্রয়াদেশের সঙ্গে পণ্য কমে গেলেও থেমে নেই শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি। এমন অবস্থার মধ্যে তুলা ও কেমিক্যালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা।
এ বিষয়ে নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খসরু চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভুগছে ইউরোপ। এরই প্রভাবে আমাদের শিপমেন্ট কমে গেছে। নতুন ক্রয়াদেশ এলেও দাম পাচ্ছি না। অথচ এর মধ্যেও শ্রমিকদের বছরের মাথায় ৫ শতাংশ হারে বেতন বাড়ছে। কিছুদিন আগে বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এখন বেড়েছে সুতা ও কেমিক্যালের দাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘সক্ষমতার ৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশ ও ১০ শতাংশ কম দামে পণ্য তৈরি করে টিকে থাকা সত্যিই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। শুধু আমরাই বিপাকে তা নয়, ওভারটাইম করতে না পারায় শ্রমিকদেরও আয় কমে গেছে।’
বিশ্ববাজারে তুলার দামের সূচক প্রকাশ করে ফিউচার ডট ট্রেডিংচার্ট ডটকম। ওয়েবসাইটটিতে মূলত ২৫ দশমিক ৪ মিলিমিটার গ্রেডের তুলার দাম প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে ২৮-৩০ মিলিমিটার গ্রেডের তুলার ব্যবহার বেশি, যার পাউন্ডপ্রতি দাম ২৫ দশমিক ৪ মিলিমিটার গ্রেডের চেয়ে ১২ সেন্ট বেশি পড়ে। বড় স্পিনিং (সুতা) মিলগুলো সাধারণত দুই বছরের তুলার আগাম বুকিং দেয়। অনেকে আবার এক বছর আগে বুকিং দেয়। তবে ছোট কারখানাগুলো ২৫-৩০ দিনের মধ্যে তুলা বুঝে পাবে এমন বুকিংও দিয়ে থাকে।
গত শুক্রবারের ট্রেডিংচার্টের তথ্য অনুযায়ী, তাৎক্ষণিক বুকিং দিলে তাকে ২৫ দশমিক ৪ মিলিমিটার গ্রেড প্রতি পাউন্ড (১ কেজি সমান ২.২০ পাউন্ড) তুলার জন্য দিতে হচ্ছে ৭৩ দশমিক ৩৯ সেন্ট (১ ডলার সমান ১০০ সেন্ট)। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের জন্য বুকিং দাম ৭৩ দশমকি ৭০ সেন্ট, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের জন্য ৬৯ দশমিক ২২ এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরের জন্য এই দর ৬৮ দশমিক ৩০ সেন্ট। বাংলাদেশের জন্য এই দামের সঙ্গে অতিরিক্ত ১২ সেন্ট যোগ করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের (আইআইএসডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে তুলা উৎপাদনে শীর্ষ ৫ দেশ যথাক্রমে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও পাকিস্তান। ২০১২ সালে বিশ্ব ব্যাপী তুলা উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২৭ মিলিয়ন টন। বিশ্বব্যাপী গড়ে ২৪ মিলিয়ন টন তুলার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে তুলার এ চাহিদা আরও বেড়েছে। কিন্তু করোনাকালে উৎপাদনে ব্যাপক ধস নেমেছে। ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাডভাইজারি কমিটির (আইসিএসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ সেশনে বিশ্বব্যাপী তুলা উৎপাদন ২৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন সমান ১০ লাখ) টন থেকে ২৪ দশমিক ৭ মিলয়ন টনে নেমে এসেছে। মৌসুম শেষে এটি ২১ দশমিক ৭ মিলিয়ন টনে নেমে আসতে পারে।
পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় ওয়েবপোর্টাল জাস্ট স্টাইল বলছে, করোনা মহামারী পরিস্থিতির উন্নতি হলে ২০২১-২২ মৌসুমে ২৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন তুলা উৎপাদন হতে পারে। তুলা আমদানির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আগাম বুকিং দেয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে হঠাৎ করে বিশ্ববাজারে তুলার দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে গোটা টেক্সটাইল খাতে।
টেক্সটাইল মিল মালিকরা বলছেন, তারা মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ক্যামেরুন থেকে তুলা আমদানি করেন। আগে অনেকে ভারত থেকে আমদানি করলেও স্প্রে করা তুলা ও মান নিয়ে প্রতারণা করায় এখন তারা আমদানি করেন না। বেশিরভাগ নিট পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি দেশীয় সুতা ব্যবহার করে। তারা মূলত ২৪-৩০ কাউন্টের সুতা ব্যববহার করে। অনেকে আবার ৪০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করে। কাউন্ট বাড়লে সুতার দামও বেশি হয়। গত নভেম্বর শেষে কেজিপ্রতি ২৪-৩০ কাউন্টের সুতা বিক্রি হয় ২ দশমিক ৯৫ ডলারে। গত শুক্রবার একই মাপের সুতা বিক্রি হয় ৩ দশমিক ২৫ ডলার থেকে ৩ দশমিক ৩০ ডলারে। ডিসেম্বরের শুরুতে কেজিপ্রতি ৪০ কাউন্টের সুতা ৩ দশমিক ৩০ ডলারে বিক্রি হলেও এখন তার দাম ৩ দশমিক ৬০ ডলার।
এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে কেমিক্যালের দামও বেড়েছে। কেমিক্যাল সরবরাহের শীর্ষ ৫ দেশ যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও জাপান কমবেশি করোনায় বিপর্যস্ত। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও রাশিয়া। এরই প্রভাবে দেশগুলোর কেমিক্যাল উৎপাদনে ধস নেমেছে। অবশ্য বিশ্বে কেমিক্যালের চাহিদাও কিছুটা কমেছে। কিন্তু সরবরাহের তুলনায় তা খুবই নগণ্য হওয়ায় গড়ে কেমিক্যালের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে।
সুতা ও কেমিক্যালের দাম বাড়ায় ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে পোশাক কারখানা মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। তবে ক্রেতারা এসব শুনতে নারাজ বলে জানান আন্তর্জাতিক অ্যাপারেল ফেডারেশনের পরিচালক ও ফতুল্লা অ্যাপারেলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, ‘সুতার দাম বাড়ায় আমরা ক্রেতাদের কাছে পণ্যের দামও বাড়ানোর অনুরোধ করি। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞার কারণে বড়দিন উপলক্ষে বিক্রিতে ধসের অজুহাতে তারা দাম বাড়াতে পারবেন না বলেছেন। তবে আশার কথা, করোনার টিকা এসে গেছে। ফলে আমরা লোকসান দিয়ে হলেও মৌসুমটা পার করার চেষ্টা করছি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য আরেকটি প্রণোদনা দিচ্ছেন। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন হলে হয়তো অনেক কারখানা বন্ধের হাত থেকে রেহাই পাবে।
লেখক: আরিফুর রহমান তুহিন
সূত্র: দেশ রূপান্তর