একসময়ের এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কারখানা এখন বন্ধ

প্রতিবেদন

দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম পথিকৃৎ উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহা। ১৯৮৪ সালে ওপেক্স গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের মাধ্যমে স্থাপন করেন পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও। ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কাঁচপুরে ৪৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তার এ শিল্প উদ্যোগ বস্ত্র ও পোশাক খাতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র। প্রায় ৪০ বছর আগে বাংলাদেশের সেরা ব্র্যান্ড ছিল ওপেক্স।

কিন্তু নগদ মূলধনের অভাব, শ্রম অসন্তোষ, ঋণ দায়সহ নানামুখী সংকটে পড়ে ২০২১ সালে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ পোশাক কারখানা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কাঁচপুরের কারখানা কমপ্লেক্সটি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করে।

একসময়ে বিশাল এ শিল্প গ্রুপের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমা ক্রেতাদের নজর কেড়েছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। ওই সময় পোশাকের কার্যাদেশ দিতে দিনের পর দিন তার সাক্ষাৎ লাভের অপেক্ষায় থাকতেন ক্রেতারা। সাক্ষাতের জন্য সময় না পেলে অনেকে তার বিদেশযাত্রার সময়সূচি সংগ্রহ করতেন। লক্ষ্য থাকত, বিমানে একান্তে পেলে ক্রয়াদেশের বিষয়ে কথা বলা। কিন্তু সবই এখন রূপকথা।

গত ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কাঁচপুর শাখার কারখানায় বন্ধের নোটিশ দেয়া হয়। গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) কমান্ডার বানিজ আলী (অব.) স্বাক্ষরিত ওই নোটিশের ১৯ অক্টোবর থেকে স্থায়ীভাবে কারখানা বন্ধের ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়।

কারখানা চালিয়ে রাখার মতো আর্থিক সংগতি বা সামর্থ্য মালিকের নেই উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, এ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে শিল্প ও শিল্পসংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ২৮(ক) ধারা অনুযায়ী ওপেক্স গ্রুপ, কাঁচপুর শাখার সব গার্মেন্ট ইউনিট ও ওয়াশিং প্লান্টসহ সংশ্লিষ্ট সব ইউনিট ১৯ অক্টোবর থেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো।

কয়েক বছর ধরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কারখানায় প্রায়ই সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। যৌক্তিক অযৌক্তিক নানা দাবিদাওয়া নিয়ে কর্মীরা চাপ দিতেন কর্তৃপক্ষকে। আইনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সুবিধা দিতে বাধ্য হতেন আনিসুর রহমান সিনহা। এতে তার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। এর ফলে বড় উৎপাদন সক্ষমতা পূর্ণ সচল রাখাও সম্ভব হচ্ছিল না। আনিসুর রহমান সিনহার জন্য সাম্রাজ্য তখন বোঝায় পরিণত হয়। এ বোঝা বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কাজের নেশায় তিনি একের পর এক সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলোই তার হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যবসায়িক কার্যালয় খুলেছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। যুক্তরাজ্য, হংকং, চীন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রেও আছে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইলের কার্যালয়। যুক্তরাজ্যে আছে ওপেক্স ফ্যাশন লিমিটেড নামের লিয়াজোঁ অফিস। ২০১০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। বিশ্বের সব নামকরা বড় ক্রেতার কাজগুলোর সমন্বয় ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই অফিসটি চালু করেছিলেন তিনি। সেখানে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে রয়েছেন তার একমাত্র সন্তান তানজিয়া সিনহা। বাংলাদেশসহ চীন ও ভারতের ১৪০টিরও বেশি কারখানাকে ওপেক্স ফ্যাশন ইউকের উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হয় বলে দাবি ওপেক্স ফ্যাশন ইউকের।

ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপে অনেক সমস্যা আগে থেকেই চলে এলেও সেগুলো প্রকট হয় রানা প্লাজা ধস পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। কারখানা মূল্যায়নে নিয়োজিত জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স অযাচিতভাবে সিনহার কারখানা ইউনিটগুলোর ভবন ত্রুটি নিয়ে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে দেয়। আগে অনেক বড় ক্রেতা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহায় কাজ দিত। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তাণ্ডবে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিলের পাশাপাশি অনেক পণ্য মজুদ পড়ে থাকে তার কারখানায়।

পোশাক খাতের শিল্প মালিক সংগঠনের এক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আনিসুর রহমান সিনহা তার হাতে গড়া গ্রুপটি বিক্রির উদ্যোগও একাধিকবার নিয়েছেন। ভারতের রিলায়েন্সসহ আরো কিছু কোম্পানি তা ক্রয়ের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও করেছে। কিন্তু দেনাসহ অনেক বড় হয়ে যায় বিনিয়োগের পরিমাণ। আর আনিসুর রহমান সাহেবও কম দামে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। এ কারণে এত বড় প্রকল্পের ক্রেতা চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পোশাক শিল্প মালিক সংগঠনের ওই প্রতিনিধি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের একজন উদ্যোক্তাকে ভুঁইফোড় শ্রমিক সংগঠন ও নেতাদের তরফ থেকে অনেক অন্যায্য দাবি মানতে হয়েছে। তারা ধীরে ধীরে ওনাকে উৎপাদন থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করছেন। শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে আনিসুর রহমান সিনহার ভুলও ছিল। কারখানা পরিচালনায় যে লোকবল তিনি নিয়োগ করেছেন তাদের অব্যবস্থাপনাও বর্তমান দুর্দশার অন্যতম বড় কারণ।

সূত্র: বণিক বার্তা

শেয়ার করুন