সেই ১৯৬৩ সালের কথা। পুরান ঢাকার উর্দু রোডে যাত্রা শুরু রিয়াজ স্টোর নামে এক দর্জি দোকানের, যার মালিক রিয়াজ উদ্দিন। রিয়াজ স্টোরে তৈরি করা জামা-কাপড় দেশের ভেতরেই বিক্রি হতো। পাক্কা ব্যবসায়ী রিয়াজ উদ্দিন ১৯৬৫ সালে করাচি ভ্রমণে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের একটি গার্মেন্টস কারখানা মাসে এক লাখ পিস তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করছে। তখন থেকেই তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের বীজ বপন হয় রিয়াজ উদ্দিনের মনে। সেই স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়ে ১৯৭৩ সালে রিয়াজ স্টোরের নাম বদল করে রিয়াজ গার্মেন্টস নাম দেন তিনি। ব্যবসা সম্প্রসারণও করেন। তখন থেকেই রপ্তানির চেষ্টা শুরু করেন তিনি। অবশেষে অধরা সেই ক্ষণ ধরা দেয় তারও পাঁচ বছর পরে, ১৯৭৮ সালে। ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান ১০ হাজার পিস ছেলেদের শার্ট আমদানির অর্ডার দেয় রিয়াজ গার্মেন্টসে। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই সরকারের বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’র সহায়তায় ১০ হাজার পিস শার্ট প্যারিসে রপ্তানি করেন রিয়াজ উদ্দিন। দেশ থেকে প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয় ১৩ মিলিয়ন ফ্রাংক, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১০ কোটি টাকার মতো। ১৯৭৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪ লাখ টাকা।
সেই থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পরিচয় হতে থাকে। তারপরে অন্য আরও কয়েকটি কারখানা পোশাক রপ্তানির চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৭৮ সালে ৯টি কারখানা পোশাক রপ্তানি করে প্রায় ১০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল। রিয়াজ গার্মেন্টসহ তখন দেশের চারটি পুরাতন গার্মেন্ট কারখানার মধ্যে ছিল প্যারিস গার্মেন্টস, জুয়েল গার্মেন্টস ও বৈশাখী গার্মেন্টস।
শুরু থেকেই রিয়াজ উদ্দিন তার গার্মেন্টসে নারী শ্রমিক নিয়োগের জন্য অনেক চেষ্টা করেন। তবে সফল হতে পারেননি। নারীদের গার্মেন্টসের কাজে আগ্রহী করতে তখন তিনি নিজের মেয়েকে প্রথম রিয়াজ গার্মেন্টসে পোশাক তৈরির কাজে লাগিয়ে দেন। তার মেয়েকে দেখে আরও কিছু নারী এই পেশায় আসতে আগ্রহী হন এবং আস্তে আস্তে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে পোশাক শিল্পে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখ, যার মধ্যে ৩০ লাখেরও বেশি নারী।
রিয়াজ গার্মেন্টসের তৈরি পোশাক তখন বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পায়। বিশ্বের নাম করা কিছু মানুষ এ গার্মেন্টসের পোশাক পরে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালে ৩ নভোচারী নিল আমস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স তাদের পোশাক পেয়ে লিখেন ‘We wish to thank you for your thoughtful gift of three shirts which was presented to us during our visit to Dacca.’’ ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় কৃষি শিল্প মেলায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রিয়াজ গার্মেন্টসের প্যাভিলিয়ন। দেশের বাজারেও বিপুল জনপ্রিয় ছিল রিয়াজ গার্মেন্টসের তৈরি পোশাক। তার কারখানায় তৈরি পোশাক নিয়ে তখনকার সংবাদপত্র ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচুর বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন রিয়াজ উদ্দিন। নায়ক রাজ্জাক এক সময় তাদের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। ৮০ দশকে তাদের অ্যাড বিটিভিতে প্রচারিত হতো।
১৯৭৯ সালে দেশে প্রথম আধুনিক শতভাগ রপ্তানিমুখী কারখানা হিসেবে গড়ে ওঠে দেশ গার্মেন্টস। দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়্যু করপোরেশনের সঙ্গে দেশ গার্মেন্টস প্রযুক্তিগত এবং বাজারজাতকরণে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করে। প্রথম দিকে মেশিনে কাজ করার মতো উপযোগী করে তোলার জন্য শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ জন মহিলাসহ ১২০ জন পরিচালক (মেশিন) দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় এবং এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই ১৯৮০ সালে দেশ গার্মেন্টসে উৎপাদন শুরু করে। ১৯৮০ সালে ইয়াঙ্গুন নামে অপর একটি কোরিয়ান করপোরেশন বাংলাদেশি ট্রেকসীম লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে প্রথম যৌথ উদ্যোগে তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে তোলে। বাংলাদেশি অংশীদাররা নতুন প্রতিষ্ঠান ইয়াঙ্গুনস বাংলাদেশ-এ শতকরা ৫১ ভাগ ইক্যুইটির মালিক হন। এটি প্রথম ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে প্যাডেড এবং নন-প্যাডেড জ্যাকেট সুইডেনে রপ্তানি করে। উভয় ক্ষেত্রেই বাজারজাতকরণের দায় বিদেশি অংশীদাররাই নিয়েছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাক শিল্প রপ্তানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে। পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে।
১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং ১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২,৯০০টিতে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্পের সাফল্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। ২০০৯ সালে কারখানার সংখ্যা ৩ হাজারে উপনীত হওয়ার সময় পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম, এখন চীনের পরেই । বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তন্মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থান দখল করে আছে। ১৯৯০-এর দশকে এ শিল্প খাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে বার্ষিক প্রায় ২২ শতাংশ হারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর এ খাত থেকে ৩৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমানে দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় চার হাজার।
লেখক: তামজিদ হাসান
সূত্র: দৈনিক দেশ রুপান্তর