দেশের পোশাক খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্স। বছরে প্রায় ২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করছে এ প্রতিষ্ঠান। কভিড-১৯ সংক্রমণ এড়াতে চলতি বছর প্রায় দুই মাস উৎপাদন বন্ধ রাখতে হলেও প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে উৎপাদন লাইন বৃদ্ধি করেছে। এজন্য অদূর ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ জনবলও নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। মালিকপক্ষ বলছে, উৎপাদন বন্ধ না রাখলে চলতি বছর শেষে অবধারিতভাবেই রফতানি বাড়ত স্নোটেক্সের। চলতি বছর শেষে রফতানি টার্নওভার হয়তো বাড়বে না, কিন্তু গত বছরের মতো এবারো ২৫ কোটি ডলারের রফতানি হওয়ার আশা রয়েছে।
গত অক্টোবরে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয় দেশের অন্যতম বড় পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের বিজ্ঞাপনে নতুন কারখানা ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল। যোগাযোগের জন্য যে নম্বর দেয়া হয়েছিল সেখানে ফোন করা হলে কর্তৃপক্ষ জানায়, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই নতুন কারখানা কিনতে হচ্ছে তাদের।
বৈশ্বিক কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশের পোশাক খাতের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, এটা একটা বাস্তবতা। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও বাস্তবতা যে এ মহামারীর প্রভাবে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের ক্রয়চর্চায় পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রেতাদের ক্রয় মানসিকতার প্রভাবে তুলনামূলক ছোট কারখানাগুলোর উৎপাদন অনেকাংশে কমেছে। ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে বড় পোশাক কারখানার ব্যবসা।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিসংখ্যানেও বড় কারখানার ব্যবসা শক্তিশালী হওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংগঠনের সক্রিয় ১ হাজার ৩৩৪ সদস্য কারখানা মোট ১ হাজার ৯৩২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। যার ১ হাজার ২২৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের রফতানি করেছে বৃহৎ ৩৫১ কারখানা। এ হিসাবে মোট রফতানির ৬৩ শতাংশই করেছে বৃহৎ কারখানাগুলো। বাকি ৩৭ শতাংশ রফতানি করেছে মাঝারি ও ছোট ৯৮৩ কারখানা। মাত্র ১৫ শতাংশ রফতানি করেছে ছোট ৬৪২ কারখানা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, মোট রফতানির ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখা কারখানার সংখ্যা এখন চারশরও নিচে। ছোট কারখানা এখন আগের চেয়ে অনেক কম। ক্রেতারা তাদের সরবরাহকারী ভিত্তি কনসোলিডেট করছে। বড় পরিমাণ উৎপাদনের প্রস্তাব দেয়ার সক্ষমতা আছে এমন কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোর দিকে তাদের মনোযোগ। কনসোলিডেশনটা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে।
বিজিএমইএর হিসাবে ২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন এমন ৩৫১ কারখানা মোট রফতানির ৬৩ শতাংশ করেছে গত অর্থবছরে। এর মধ্যে একক ইউনিট ভিত্তিতে শীর্ষ ২০ পোশাক রফতানিকারক কারখানার নাম হাতে পেয়েছে বণিক বার্তা। এ কারখানাগুলো গত অর্থবছরে ন্যূনতম ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২৩ কোটি ডলারের রফতানি করেছে। শীর্ষ এ ২০ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও কভিড-১৯-এর প্রভাবে বড় কারখানাগুলোর ব্যবসার ভিত আরো শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
বিজিএমইএর শীর্ষ ২০ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের তালিকার শুরুতেই আছে ইউনিভার্সাল জিনস লিমিটেড। বছরে ১০ থেকে ২৩ কোটি ডলারের রফতানি করা প্রতিষ্ঠানটির মূল প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিনস। ১৯৮৪ সালে যাত্রা করে বর্তমানে ৩০ হাজার শ্রমিকের এ গ্রুপ বছরে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করে। প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কভিডের প্রভাবে ব্যবসার ভিত শক্তিশালী হওয়ার বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন তারা।
প্যাসিফিক জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভির বণিক বার্তাকে বলেন, লোয়ার ক্যাটাগরির বা ছোট কারখানাগুলোর ক্রয়াদেশ কমছে কিছুটা কভিডের কারণে। এ অবস্থায় বড়দের সিকিউরিটির জায়গাটি নিশ্চিতভাবেই বেটার। বড়রা প্রকৃত অর্থে বেটার পজিশনে থাকবে।
শীর্ষ ২০ পোশাক রফতানিকারক কারখানার মধ্যে দশম অবস্থানে রয়েছে দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড বা ডিবিএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফ্লেমিঙ্গো ফ্যাশনস লিমিটেড। বস্ত্র, পোশাক, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ব্যবসা থাকা ডিবিএল গ্রুপে কর্মী সংখ্যা ৩৮ হাজারেরও বেশি, বার্ষিক টার্নওভার ৬০ কোটি ডলার। এ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও বড় কারখানার ভিতর কভিডের প্রভাবে শক্তিশালী হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
ফ্লেমিঙ্গো ফ্যাশনস-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের বড় ক্রেতাদের তিন ধরনের সরবরাহকারী কারখানা আছে। এগুলো হলো প্লাটিনাম, গোল্ড ও সিলভার। প্লাটিনাম কারখানাগুলো নির্ধারণে সাতটি বিষয়ের ওপর জোর দেন ক্রেতারা। এ বিষয়গুলোর মধ্যে আছে কমপ্লায়েন্স, প্রাইস ও ক্যাপাসিটি, ডকুমেন্টেশন। এ ধরনের সাতটি বিষয়ের প্রতিটিতে প্রত্যাশিত সর্বোচ্চ নম্বর পেলে সেই কারখানাগুলোকে প্লাটিনাম বলা হচ্ছে। এর পরের ধাপকে গোল্ড ও সর্বশেষ ধাপটিকে সিলভার বলা হচ্ছে। সিলভার কারখানাগুলোকে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার বিষয়ে ‘না’ করে দিচ্ছে। সিলভার কারখানাগুলোর সমস্যা হলো তাদের পূর্ণাঙ্গ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ নেই।
ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এমএ রহিম বণিক বার্তাকে বলেন, সিলভার কারখানাগুলোকে ক্রেতারা এখন ‘না’ করে দিচ্ছে। এর অন্যতম কারণ কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ। ক্রেতারা মজুদ পণ্য শেষ করতে চাচ্ছে। ক্রিসমাস সেলস ভালো হয়নি। ক্রেতারা সিলভার কারখানা থেকে কম মূল্যে পোশাক কিনতে পারত। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্রয়াদেশ কম বা বেশি যা-ই দিচ্ছে তা দিচ্ছে প্লাটিনাম ও গোল্ড কারখানাগুলোকে। সিলভার কারখানায় যে ক্রয়াদেশগুলো দিত তা এখন প্লাটিনাম ও গোল্ড কারখানাগুলোকে দিচ্ছে। এমন কৌশলই নিচ্ছে ক্রেতারা। ছোটদের ছেড়ে দিচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই কনসোলিডেশন হচ্ছে।
গত অর্থবছরে একক ইউনিটভিত্তিক শীর্ষ ২০ পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাদশতম প্রতিষ্ঠানটি হলো স্নোটেক্স আউটারওয়্যার লিমিটেড। স্নোটেক্স প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত স্নোটেক্স আউটারওয়্যারে কাজ করেন সাড়ে সাত হাজারেও বেশি কর্মী। স্নোটেক্স প্রতিষ্ঠানের মোট কর্মী ১৬ হাজার। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রপ্ততানি টার্নওভার ২৫ কোটি ডলার।
স্নোটেক্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খালেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৯-এর চেয়ে ২০২০ সালে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ছোট ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদের উৎপাদন সক্ষমতা এতই কম যে ৫০ বা ১০০টা বন্ধ হলেও তা আদতে বড় সংখ্যা নয়। বড়দের মধ্যে ২০১৯ সালে যারা কারখানা চালু করেছেন তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে, যেমন আমাদের বেড়েছে। গত ছয় মাসে দুই-তিন হাজার নিয়োগ দিতে হয়েছে। আগামী ছয় মাসে হয়তো আরো দুই-তিন হাজার কর্মী নিয়োগ দিতে হবে।
যারা সক্ষমতা বাড়িয়েছে তারা বাড়তি কিছু ক্রয়াদেশ যে পায়নি তা নয়, এমন তথ্য উল্লেখ করে এসএম খালেদ বলেন, যারা পরিবেশবান্ধব, সক্ষমতা বেশি, নতুন বিনিয়োগ করেছেন তারা যে খুব সমস্যায় পড়েছেন তেমনটা বলা যাবে না। আবার একদম সমস্যা হয়নি, তাও বলা যায় না। আমাদের ক্ষেত্রেই কভিডের প্রভাবে উৎপাদন বন্ধ করতে না হলে গত বছরের মতো এ বছরও ২৫ কোটি ডলারের রপ্তানি টার্নওভার থাকবে বলে আশা করছি।
সূত্র: বণিক বার্তা