বিশ্বের সর্ববৃহৎ টি-শার্টে উৎপাদন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ

অন্যান্য

পর্তুগিজদের আগমন ঘটে সতেরো শতকের প্রথম ভাগে। আঠারো শতাব্দীতে আসে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা। গুরুত্ব বাড়ে নারায়ণগঞ্জের। ১৯২৭ সালে শীতলক্ষ্যা তীরে বাবু সূর্য কুমার বোস গড়ে তোলেন ঢাকেশ্বরী কটন মিল। এর দুই বছর পর প্রতিষ্ঠা পায় চিত্তরঞ্জন কটন মিল। পাকিস্তান আমলে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে পাটের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। পরিচিতি পায় ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’ হিসেবে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পাটের পরিবর্তে তুলাজাত সুতার আধিপত্য বাড়তে থাকে। কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের প্রধান হোসিয়ারি উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জ।

দেশে সুতা থেকে উৎপাদিত নিট পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত টানবাজার দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি তুলাভিত্তিক সুতার বাজার। ক্ষয়িষ্ণু সুতা ব্যবসায়ীরা এখনো পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। ব্রিটিশ শাসনের শেষার্ধে নারায়ণগঞ্জে উৎপাদিত সুতা ও কাপড়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। সে সময়ে নারায়ণগঞ্জকে বলা হতো ‘ম্যানচেস্টার অব এশিয়া’। ২০০ বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকে রফতানীকৃত টি-শার্টের বৈশ্বিক বাজারের উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ।

পোশাকের বৈশ্বিক বাজারের আকার ১ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। এ বাজারে স্বল্পমূল্যের টি-শার্ট যেমন আছে, তেমনি আছে উচ্চমূল্যের ওভার কোট, স্যুট ও ডেনিম জ্যাকেট। তবে এর মধ্যে অন্যতম পণ্য টি-শার্ট। পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলো বছরে ৪৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি টি-শার্ট রফতানি করে। পণ্যটির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া টি-শার্টের সিংহভাগই তৈরি হয় নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা নিট পোশাক কারখানাগুলোতে।

ওয়ার্ল্ডস টপ এক্সপোর্টসের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের টি-শার্ট রফতানিকারকদের মধ্যে প্রথম অবস্থানেই আছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানটি বাংলাদেশের। আর বাংলাদেশের পর অবস্থান করা দেশগুলোর মধ্যে আছে যথাক্রমে তুরস্ক, ভারত, জার্মানি, ভিয়েতনাম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও বেলজিয়াম।

রফতানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের টি-শার্ট রফতানিকারক চীনের পোশাক কারখানাগুলো বিভিন্ন প্রান্তে ছড়ানো-ছিটানো। অর্থাৎ দেশটির টি-শার্ট উৎপাদন একটা শহরেই সীমিত নয়। আর বাংলাদেশী টি-শার্টের ৭০ শতাংশই উৎপাদন হয় নারায়ণগঞ্জে। ভৌগোলিক অবস্থান ও টি-শার্ট তৈরিতে ব্যবহৃত সুতার শত শত বছরের ইতিহাসই নারায়ণগঞ্জকে এর বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে সুতা বাণিজ্যের ইতিহাস ২০০ বছরের পুরনো। নিটওয়্যার শিল্পের উত্থানই নারায়ণগঞ্জ থেকে। তাই নারায়ণগঞ্জকে নিটওয়্যার সিটিও বলা যায়। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কারখানার জন্ম হচ্ছে। সারা বিশ্বেই নারায়ণগঞ্জ থেকে নিটওয়্যার, বিশেষ করে টি-শার্ট রফতানি হয়। এর শুরুও হয় নারায়ণগঞ্জ থেকেই। এখনো বাংলাদেশের সুতার বাজার মূলত নারায়ণগঞ্জকেন্দ্রিক। আর রফতানিমুখী কারখানার সুতাও টানবাজার থেকে যায়। এ সুতা থেকে টি-শার্ট তৈরি হয়ে তা বিশ্ববাজারে যায়। এ প্রেক্ষাপটে টি-শার্টের বৈশ্বিক বাজারের কেন্দ্র হলো নারায়ণগঞ্জ।

খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, নিটওয়্যার পণ্যের উৎপাদন ক্ষেত্র নারায়ণগঞ্জ থেকে এখন কিছুটা ছড়িয়ে গেলেও শুধু টি-শার্টের ক্ষেত্রে এখনো বড় অংশই রফতানি হয় এখান থেকে। মোট টি-শার্ট রফতানির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হয় নারায়ণগঞ্জ থেকেই। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকেই হোসিয়ারি শিল্পের উত্তরণ। এজন্যই নিটওয়্যার পোশাকের মূল কেন্দ্রে রূপান্তর হয় নারায়ণগঞ্জ। টি-শার্ট এবং নিটওয়্যার পণ্যের বড় কারখানাগুলোও আছে নারায়ণগঞ্জেই। এখানে কারখানার সংখ্যা অনেক। কিন্তু বড় কারখানা খুব বেশি না,  ছোট-মাঝারি কারখানাই বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, নারায়ণগঞ্জে মোট শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ২ হাজার ৪০৯টি, যার মধ্যে পাট, তুলা, বস্ত্র ও চামড়া ১ হাজার ৩২০টি।

নারায়ণগঞ্জ এখনো টি-শার্টের হাব হলেও বর্তমান শিল্পায়নের প্রেক্ষাপটে সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়াতেও ছড়িয়ে গেছে। নিট কারখানা যাদের আছে তারা প্রায় সবাই টি-শার্ট তৈরি করে।নারায়ণগঞ্জ অনেক ছোট জায়গা। অনেক বড় কারখানা গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট স্থান এখানে ছিল না। যখনই বড় শিল্প গড়ার প্রয়োজন পড়েছে, তখনই উদ্যোক্তারা নারায়ণগঞ্জের বাইরে চলে গেছেন। এর পরও বড় নিট পোশাক কারখানার অনেকেরই কারখানা ইউনিট আছে নারায়ণগঞ্জে। নিট পোশাকে নারায়ণগঞ্জভিত্তিক শ্রম দক্ষতা ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এখানের পানিও টি-শার্ট উৎপাদনে বিশেষ উপযোগী। এ প্রেক্ষাপটেও নারায়ণগঞ্জ বৈশ্বিক টি-শার্ট বাজারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

নিটওয়্যার পণ্যের অন্যতম বৃহৎ রফতানিকারক গ্রুপ মাইক্রো ফাইবার। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার প্রকৌশলী মো. শামসুজ্জামান নাসিম (সিআইপি) বলেন, নারায়ণগঞ্জের পানি সাভার ও গাজীপুর অঞ্চল থেকে ভিন্ন। নিট পোশাক বিশেষ করে টি-শার্টে যে পানি ব্যবহার করা হয়, তা নারায়ণগঞ্জেরটিই বেশি উপযোগী। বিশেষ করে টিউবলার টি-শার্ট উৎপাদনের নারায়ণগঞ্জভিত্তিক শ্রম দক্ষতাও বেশি। পাশাপাশি আছে অঞ্চলটির সুতার ঐতিহ্যগত প্রেক্ষাপট। সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জকে বৈশ্বিক টি-শার্টের প্রধান কেন্দ্র বলা যায়।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, বাংলাদেশে রফতানিমুখী টি-শার্টের জন্মই নারায়ণগঞ্জে। হোসিয়ারি শিল্পেরও শুরু হয় এখানে। স্থানীয় বাজারে বিশেষ করে পুরুষদের ব্যবহূত অন্তর্বাস ও গেঞ্জির উৎপাদনও এখানেই শুরু। এর ধারাবাহিকতায় আশির দশকের শুরুতে প্রথমবারের মতো টি-শার্ট রফতানিও হয় নারায়ণগঞ্জ থেকেই। আজ টি-শার্ট রফতানির যে আকার, তার লালন-পালন হয়েছে এ এলাকাতেই। এখন শাখা-প্রশাখা অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জই ছিল টি-শার্টের বৈশ্বিক হাব। এখনো নারায়ণগঞ্জকে টি-শার্টের সূতিকাগারই বলা যায়। টি-শার্টের বৈশ্বিক বাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থানও এটি। সুতার ব্যবসা ছিল টানবাজারকেন্দ্রিক, রঙের ব্যবসাও ছিল এ এলাকাতেই। অর্থাৎ এমনি এমনি নারায়ণগঞ্জ টি-শার্টের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়নি, এক সময় টি-শার্টের এক্সপার্টিজের প্রাপ্যতাও শুধুই নারায়ণগঞ্জে ছিল।

রিপোর্ট: বদরুল আলম, বণিক বার্তা

শেয়ার করুন