পোশাক রপ্তানির বিশ্ববাজারে ‘ম্যান-মেইড ফাইবার’ এবং ‘নন কটন ফাইবার’ থেকে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের হিস্যা বাড়াতে সরকারের নীতি ও আর্থিক সহায়তা প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
পোশাক রপ্তানিকারকদের ভাষ্য, বিশ্ব বাজারে গত তিন দশকে কৃত্রিম তন্তু থেকে তৈরি পোশাকের ব্যবহার দ্বিগুণ হলেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাতে এর ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। পরিবর্তিত এই বাজারে নিজেদের হিস্যা বাড়িয়ে রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনার কথা বলছেন তারা।
বিজিএমইএর নবনির্বাচিত সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “মানুষ এখন প্রাকৃতিক তুলার তৈরি পোশাকের চেয়ে নন-কটন বেইজড বা কৃত্রিম তন্তু ও সুতার পোশাক বেশি ব্যবহার করছে। অথচ বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হয়েও এক্ষেত্রে পিছিয়ে।”
তিনি তথ্য দেন, তিন দশক আগে বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া পোশাকের চার ভাগের তিন ভাগই ছিল প্রাকৃতিক তুলা নির্ভর। বাকিটা ‘নন-কটন’। তখন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির ৮০ শতাংশই ছিল প্রাকৃতিক তুলার পোশাক।
আর এখন বিশ্বে পোশাকের ৭৪ শতাংশ ম্যান-মেইড ফাইবার থেকে তৈরি। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে এখনও ৭০ শতাংশই প্রাকৃতিক তুলার পোশাক রপ্তানি হয়। দেশ এখনও প্রায় আগের অবস্থানেই আছে।
বাংলাদেশ ১৯৯১-০২ সালে ১১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল, যা ছিল ওই বছর মোট রপ্তানির ৫৯ শতাংশ। আর এখন গত তিন বছর ধরে গড়ে তিন হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হচ্ছে।
এ অবস্থায় রপ্তানি আয় বাড়াতে কৃত্রিম তন্তু ও ফাইবারের ব্যবহার বাড়াতে চান পোশাক শিল্প মালিকরা। সেই প্রত্যাশায় তারা আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ‘ম্যান-মেইড ফাইবারে’ সরকারের নীতি সহায়তা চাইছেন।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “কটন পণ্য এখন যা রপ্তানি হচ্ছে তা অব্যাহত থাকুক। যেহেতু নন-কটনের বাজারে বড় প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, তাই আমরা মনে করছি প্রস্তুতি নিতে পারলে খুব সহজেই এ বাজারে প্রবেশ করা যাবে। সেজন্য সরকারের শুল্ক সুবিধা, নীতি সুবিধা কিংবা প্রণোদনা ভালো সহযোগিতা করবে।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে টেক্সটাইল স্পিনিং মিলে ব্যবহৃত সব ধরনের তুলায় শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সব ধরনের সুতার ওপর সমান হারে মূসক ধার্য করার কথা বলা হয়।
এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের টেক্সটাইল স্পিনিং মিলগুলোতে কাঁচামাল হিসাবে কাঁচা তুলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফাইবার ব্যবহৃত হচ্ছে। আগামীতে হয়ত অন্যান্য ফাইবারও সুতা তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। এই বিবেচনায় সব ফাইবারের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।
বর্তমানে ভারত, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাকৃতিক তুলা আমদানি করা হয়। আর কৃত্রিম তন্তুর কাঁচামাল মূলত আসে ইন্দোনেশিয়া, চীন ও মাধ্যপ্রাচ্য থেকে।
বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিলগুলোতে প্রায় ২০ ধরনের ম্যান মেইড ও নন কটন ফাইবার ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে পিএসএফ বা পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার, ভিসকস স্টাপল ফাইবার, টেনসিল (পেট্রো কেমিকেল ফাইবার), মোডাল (পেট্রো কেমিকেল ফাইবার), পাইনঅ্যাপল ফাইবার, ব্যাম্বো ফাইবার, জুট ফাইবার অন্যতম।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “বিশ্বে ম্যান-মেইড ফাইবারের ব্যবহার বাড়ছে। এই ফাইবার দেশে উৎপাদন হয় না, তাই আমরা সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। আমরা জানি শুল্ক আরোপ করা হয় দেশীয় শিল্প সুরক্ষায়। তাই এই পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক অযৌক্তিক।”
বর্তমানে তুলা থেকে উৎপাদিত সুতায় প্রতি কেজিতে ৩ টাকা করে মূসক ধার্য আছে। বিপরীতে ম্যান-মেইড সুতার মূসক ৬ টাকা করে। দুটি পণ্যেই সমান হারে ৩ টাকা করে মূসক ধার্যের দাবি জানান খোকন।
বস্ত্র শিল্প খাতের বিভিন্ন মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। কিন্তু যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে এই শুল্ক ২৬ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ১০৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত। মূলধনী যন্ত্রের মত এসব যন্ত্রাংশের শুল্কও ১ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং এনবিআরের তালিকায় যন্ত্রাংশগুলোর আলাদা আলাদা কোড (হারমোনাইজড সিস্টেম কোড) না রেখে একই কোড ব্যবহারের দাবি তুলে ধরা হয়েছে চিঠিতে।
পোশাক মালিকদের যুক্তি: এ খাতে যে কোম্পানি থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি কেনা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকেই খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতে হয়। ফলে আলাদা আলাদা এইচএস কোড ও শুল্ক ‘নিরর্থক’, যা আমলাতান্ত্রিক ‘জটিলতাই বাড়ায়’।
টেক্সটাইল ও আরএমজি খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের যোগান অব্যাহত রাখা, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি এবং এ দুই খাতকে আরও প্রতিযোগিতাসক্ষম করে গড়ে তুলতে এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
তিনি বলেন, “অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাজেটপূর্ব আলোচনায় এসব বিষয় তুলে ধরেছিলাম আমরা। এখন শিল্প খাতের দাবি ও গুরুত্ব বিবেচনায় সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরে চিঠি দিয়েছি।”
কটনপণ্য থেকে এ মুহূর্তে নন-কটন পণ্যে মনোযোগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা যে উচ্চ মূল্যের পোশাকের বাজারের কথা বলছি তার সবই নন-কটন ফেব্রিক্স থেকে তৈরি। তাই রপ্তানি বাজারে হিস্যা বাড়াতে ওই দিকে যেতে হবে।”
কৃত্রিম তুলার শুল্ক বাধাগুলো দূর করে সমান সুযোগ নিশ্চিত করলেও অনেক সুফল পাওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন ফারুক হাসান।
তিনি বলেন “এখন দেশের কারখানাগুলোর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে, যা নন-কটন ফেব্রিক্স তৈরির সক্ষমতা বাড়িয়েছে। এ ধরনের পণ্য তৈরিতে ডায়িং, ফিনিশিং, ওয়াশিং ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক কাজগুলোও পরিবেশবান্ধব।”
বিটিএমএর সেক্রেটারি মনসুর আহমেদ বলেন, “সরকার যে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় বাড়াতে চাইছে, তার জন্য কৃত্রিম ফাইবারের ওপর থেকে শুল্ক বাধা দূর করা খুবই জরুরি। কারণ কটন বা তুলায় কোনো ধরনের আমদানি শুল্ক না থাকলেও ম্যান মেইড ফাইবারে আমদানি শুল্ক, অগ্রিম শুল্ক, আগ্রিম ভ্যাট, ভ্যাটসহ প্রায় ৩৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। এসব সুতায় ভ্যাটও ধরা হয় বেশি।
“তারপরও ক্রেতাদের আগ্রহের কারণে গত ৫ বছরে ম্যান মেইড ফাইবারের বাজার ১০ গুণ বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে যেখানে বছরে ১০ হাজার টন ম্যান মেইড ফাইবার আমদানি হত, সেখানে এখন হচ্ছে এক লাখ টন। শুল্ক বাধা দূর করলে এটা কোথায় পৌঁছাবে তা চিন্তা করা দরকার।”
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্যে বিশ্বে সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীন, রপ্তানি বাজারের ৩০ দশমিক ৮ শতাংশের অংশীদার। আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের হিস্যা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ৬ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশের ঠিক পেছনেই রয়েছে ভিয়েতনাম।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম