ইউরোপের বাজারের জন্য তৈরি হয়ে কারখানাতেই পড়ে আছে পণ্য। জাহাজীকরণের জন্য প্রস্তুত প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ ডলারের পোশাক। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ক্রেতা পণ্য নিচ্ছেন না। এদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে সময়মতো মূল্য পরিশোধ না হওয়ায় মজুদ পণ্য নিয়ে বিপাকে রয়েছেন প্রস্তুত ও রফতানিকারক কারখানার উদ্যোক্তা।
তৈরি হওয়ার পর ক্রেতা নিচ্ছেন না এমন ঘটনার চেয়েও পোশাক রফতানিকারকদের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করেছে হাতে পণ্য পেয়েও মূল্য পরিশোধে বিলম্ব করা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের অপরিশোধিত মূল্য না পেয়ে অনেক রফতানিকারকেরই ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
প্রস্তুতকৃত পণ্য না নেয়া, আমদানি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধে বিলম্ব এসব সমস্যার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা। কভিডের প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে ২০২০ সালের এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া ক্রয়াদেশের মধ্যে সোয়া ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। এ হিসাব নিয়ে রফতানিকারকরা প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করলে ক্রেতারা নাখোশ হয়েছিলেন।
ক্রেতারা নাখোশ হলেও গত বছরের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের হিসাব প্রকাশ করেছিল পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে যা সহায়তা করেছিল পোশাক খাতের সুবিধা আদায়ে সামষ্টিক দর-কষাকষিতেও। কিন্তু বাংলাদেশে চলমান কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করছেন ক্রেতারা। তাদের নাখোশ মনোভাবে ক্রয়াদেশ বাতিলের তথ্য প্রকাশেও অনীহা দেখা যাচ্ছে পোশাক শিল্প মালিকদের মধ্যে।
২মে সদস্য কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে বাতিল বা স্থগিত ও মূল্য পরিশোধ থাকা ক্রয়াদেশের বিষয়ে জানতে চেয়েছে বিজিএমইএ। কিন্তু সংগঠনের এ আহ্বানে তেমন সাড়া দিচ্ছেন না মালিকপক্ষ। একইভাবে নিট পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিকেএমইএও তাদের সদস্যদের কাছে ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত ও মূল্য পরিশোধ-সংক্রান্ত তথ্য চাইলেও আগের তুলনায় সাড়া অনেকটাই কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যারা দেউলিয়া ও বন্ধ হয়েছে, তাদের মূল্য পরিশোধ আটকে গেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এখন ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার বিষয়ে এখন অনেকটাই দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব নিয়ে আছেন। মূল্য পরিশোধের চূড়ান্ত সময় পেরিয়ে গেছে এমন ঘটনা কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আছে। সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ব্যাংকেও অনেক সমস্যা হচ্ছে। সাম্প্রতিক ব্যাংকে যে শর্টফল দেখা যাচ্ছে তা মূলত মূল্য পরিশোধে অতিরিক্ত বিলম্বের কারণেই। ক্রেতাভেদে সমস্যাগুলোও ভিন্ন।
বর্তমানে কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব মূল্যায়নে আমরা কারখানা থেকে তথ্য নিচ্ছি এমন তথ্য উল্লেখ করে ফারুক হাসান বলেন, গতবার অনেক কারখানা মালিক আমাদের আহ্বানে সাড়া দিলেও এখন অনেকেই তথ্য দিতে চাচ্ছেন না ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে। গতবার গণমাধ্যমে অনেক ধরনের তথ্য চলে আসা নিয়ে ক্রেতারা খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাই এবার অনেকেই তথ্য দিতে চাচ্ছেন না। তবে এটা নিশ্চিত যে গতবারের চেয়ে এবারের ক্ষতি অনেক কম। কারণ এবার ক্রেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ধীরে ধীরে। তাই মালিকরাও ধীরে ধীরে তাদের ক্ষতির তথ্য দিচ্ছেন। তথ্য দিলে সামষ্টিকভাবে কাজ করতে অনেক সুবিধা হয়।
করোনার সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। এর আগে থেকেই বৈশ্বিক পোশাক খাতে ভঙ্গুরতা দেখা যাচ্ছিল। ব্যবসা সংকোচনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মানসিকতায় ছিল ছোট-বড় ক্রেতাদের অনেকেই। ফলে অনেক খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আরো দুর্দশায় পড়ে যান। সংক্রমণ প্রতিরোধে অবরুদ্ধতার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখতে হয় বিক্রয়কেন্দ্র। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও পোশাক রফতানিকারকদের ক্রয়াদেশ বাতিল হয় একের পর এক, যা সংকলন করে বাতিল ও স্থগিত পরিস্থিতি প্রকাশ করেছিল সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। তবে এবার ক্রেতা হারানোর ভয়ে মালিকরা তথ্য দিতে চাচ্ছেন না।
বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ক্রয়াদেশ বাতিলের তথ্য দেয়ায় গতবার ক্রেতারা নাখোশ হয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ক্রয়াদেশ দেয়া হবে না এমন মনোভাবও ক্রেতাভেদে প্রকাশ পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে করোনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাদের মতে, কভিডের প্রভাবে ক্ষতি আরো বেশি হতে পারত। কিন্তু কারখানা সচল রাখা ও সরকারি প্রণোদনার মতো কার্যকর সিদ্ধান্তের কারণে এ ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। যদিও রফতানির আন্তর্জাতিক গন্তব্যগুলোর কোথাও কোথাও তৃতীয় ও দেশের করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণপ্রবাহের কারণে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সূত্র: বণিক বার্তা