মসলিন পুনরুদ্ধরের নেতৃত্ব দেওয়া ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালের গল্প

ইন্টারভিউ

খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে আবারো বাণিজ্যিকভাবে মসলিন শাড়ি উৎপাদনে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ৩শ মেট্রিক কাউন্টের ফুটি কার্পাস সুতো দিয়ে বেসরকারি উদ্যোগেই দুটি মসলিন শাড়ি তৈরি করে জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয় ২০১৭ সালে। সেটা দেখে সে বছরেই প্রায় ১৫শ কোটি টাকার ‘মসলিন পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প নেয়ার নির্দেশ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা, দিকনির্দেশনা ও সার্বিক সহযোগিতায় ৭ সদস্যের একটি গবেষকদল ইতিমধ্যে পরীক্ষামুলকভাবে ৭৩০ মেট্রিক কাউন্ট সুতা দিয়ে তৈরিও করে ফেলেছে আধুনিক অথচ পুরোনো ফ্লেভার ও গুণাগুণ রক্ষা করে ‘ঢাকাই মসলিন’ শাড়ি। যে শাড়ির একাধিক পাল্লা কোনো লেখার ওপর রাখলেও যে কেউ সেই বই পড়তে পারবেন বলে আশা গবেষকদের। আর এই গবেষক দলের কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ ২০২১ সালের জনপ্রশাসন পদক অর্জন করে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর হাতে স্থাপিত বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ‍্ববিদ্যালয়ের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান। আমাদের আজকের আয়োজন সেই আপদমস্তক টেক্সটাইলম্যান ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালকে নিয়ে।

২০১৩ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ‍্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনকালীন সময়েই ড. বেলাল মসলিনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কারণ তার পিএইচডি গবেষণার বিষয়ই ছিল টেক্সটাইল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন। মসলিন তৈরির যে প্রযুক্তি সেটা মেশিন আমলের প্রযুক্তির চেয়েও অনেক বেশি উন্নত বলেই শিক্ষাজীবনে নিশ্চিত হয়েছিলেন ড. বেলাল। মসিলেনর প্রতি প্রেমের কারনেই যুক্তরাজ্য থেকে দেশে পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে বিভিন্ন কোম্পানিকে মসলিন নিয়ে গবেষণার প্রস্তাব দিতে থাকেন। তবে কোম্পানিগুলো থেকে তেমন কোনো পজিটিভ সাড়া না মেলায় মসলিন পুনরুদ্ধার গবেষণার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে আশা আলো হয়ে ফিরে আসে সরকার ঘোষিত মসলিন ‘পুনরুদ্ধার প্রকল্পে’। সেখানেই ডাক পড়ে ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালের। ডাক পেয়ে এক মুহুর্ত দেরি না করে টেক্সটাইল শিক্ষা জীবনের অর্জিত সকল জ্ঞান নিয়েই ঝাপিয়ে পড়েন ড. বেলাল। সাত সদস্যের গবেষক দলের মধ্যে টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফুটি কার্পাস থেকে সুতা তৈরির গুরু দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। কারণ হাতে কাটা সুতার ওপর তার থেকে অভিজ্ঞ লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে একেবারেই অপ্রতুল। ফুটি কার্পাস থেকে সুতা তৈরিই ছিল মসলিন পুনরুদ্ধার প্রকল্পের সবথেকে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রকল্পের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজ-‘সুতা তৈরি’ মূলত তার হাতেই। তবে সম্মিলিতভাবে কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করার কারনে সরকার পুরো গবেষক দলকে জনপ্রশাসন পদক-২০২১ এ ভূষিত করেছে বলেই মনে করেন তিনি।

ড. আলিমুজ্জামানের এই অর্জন এবং তার ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে জানতে আমরা গিয়েছিলাম বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ‍্ববিদ্যালয়ে। তেজগাঁওয়ের প্রায় ১২ একর জমির উপর মূল ক্যাম্পাসে প্রবেশের আগেই বুটেক্সের নবনির্মিত গেইটের দিকে নজর পড়লো আমাদের। টেক্সটাইল শিল্পের মূল যন্ত্র মাকু বা সুতা প্যাচানোর হাতিয়ারকে বিশাল গেইটের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বেশ শৈল্পিকভাবে।

একটু সামনে যেতেই আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ড. বেলাল বুটেক্স ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটাই তুলে ধরা শুরু করলেন। শুরুতেই মনে হলো অস্তিত্বকে তুলে ধরতে চাচ্ছেন তিনি। হাটতে হাটতে তার ডীন অফিসে গিয়ে চায়ের কাপটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলা শুরু করলেন প্রিয় বুটেক্স ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।

১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের বন ও কৃষি মন্ত্রী থাকাকালে তেজগাঁওয়ের বর্তমান ক্যাম্পাসের এই জায়গা তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট’ এর নামে বরাদ্দ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও তার প্রায় ৬ বছর পর নারিন্দার ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রিটিশ উইভিং স্কুল’ কে তেজগাঁওয়ের বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত করা হয় পূর্ব পাকিস্তান টেক্সটাইল ইনস্টিউিট নামে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে যা নতুন নাম পায় ‘কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি’ নামে। আর এই ক্যাম্পাসেই ১৯৮৫ সালে মেধা তালিকায় স্থান করে ভর্তি হন ‘ঢাকাই মসলিন’ পুনরুদ্ধার দলের অন্যতম গবেষক ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান।

বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী হয়েও তৎকালীন একটি অধুনালিপ্ত শিল্পের প্রকৌশলী হতে চাইলেন কেন? এমন এক প্রশ্নে জানা গেলো তার শেকড়ের গল্প। বাংলাদেশের রপ্তানী অর্থনীতি যে তৈরি পোশাক খাতের ওপর দাড়িয়ে সেই খাতের প্রধান কাঁচামাল অর্থ্যাৎ তুলা উৎপাদনে দেশের প্রথম স্থানে যশোর জেলা। আর এই যশোর জেলা সদরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বেড়ে ওঠা আজকের ড. শাহ্ আলিমুজ্জামানের। পারিবারিক এবং বন্ধু মহলে যিনি ‘বেলাল’ নামেই বেশি পরিচিত। ডান হাতে ঘড়ি, মাথায় সাদা টুপি আর গায়ে পাঞ্জাবী এমন ট্রেড মার্ক পোশাকই ১৯৯৩ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা অধ্যাপক বেলালকে আলাদা করেছে অন্য শিক্ষকদের থেকে।

বিশ‍্ববিদ্যালয়ে যোগদানের দুই বছরের মাথায় বেলজিয়াম সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সেখানকার ‘ঘেন্ট বিশ‍্ববিদ্যালয়’ থেকে এমএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী অর্জন করেন অধ্যাপক বেলাল। দেশে ফিরে মনোযোগ দেন ক্লাসের পাঠদানে। ২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপের আন্ডারে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার ইনস্টিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি থেকে সে সময়ের তরুন আলিমুজ্জামান এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। একই ফেলোশীপের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের সুযোগ থাকলে একই বছর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপ বন্ধ করে দেয়। ফলে ফেলোশীপের আন্ডারে থাকা সকল ফেলোকে দেশে ফিরে আসতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপের আন্ডারে থাকা বহু গবেষক অবশ্য আর দেশে না ফিরলেও দেশের টানে প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন ড. বেলাল।

তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন ছেলে বেলায় প্রচন্ড দুরন্ত বেলাল। দেশে ফিরে টেক্সটাইল ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন করতে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন বিশ‍্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি স্কলারশীপের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তবুও বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপ পুনরায় চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর অনুরোধপত্রও লেখেন অধ্যাপক বেলাল। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১০ সালে আবারো বঙ্গবন্ধু ফেলোশীপ চালু হলে তিনি সেখানে আবেদন করেন। জুরি বোর্ডে নির্বাচিত হয়ে আবারো ম্যানচেস্টার বিশ‍্ববিদ্যালয় থেকে সেই অধরা ‘টেক্সটাইল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির’ ওপর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন। সফলভাবে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন শেষে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে সম্পূর্ণরূপে শিক্ষকতা পেশায় মনোযোগ দেন। ২০১৫ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে এখন গ্রেড ১ ভুক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন টেক্সটাইল গবেষণা নিয়ে। পাশাপাশি নিজস্ব এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গবেষণায় সুপারভাইজার হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এসব কথা বলতে বলতে বুটেক্সের নতুন এবং নান্দনিক একাডেমিক ভবন ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন আমাদের। সঙ্গে চলছে তার নানা স্মৃতিচারণ। ছাত্রাবস্থায় কিভাবে তিনি ক্যাম্পাসের বড় ভাইদের ভালোবাসা পেয়ে পড়ালেখাটাকে সুন্দরভাবে চালিয়ে গেছেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে ছাত্রলীগের ছায়াতলে সম্পৃক্ত রেখে রাজপথে মিছিলের সেই উত্তাল দিনের কথাও শোনোলেন আমাদের।

একটু থামিয়ে দিয়ে কোন ক্ষেত্রে এখন বেশি সময় দেওয়া হয়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্লাস নেওয়া, শিক্ষার্থীদের কল্যান, এবং কিভাবে ফেব্রিককে আরো বেশি অত্যাধুনিক করা যায় সেই চিন্তা ও গবেষণাতেই বশি সময় কাটে তার। তবে অন্যান্য সকল কাজের চেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাসেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।

নতুন বিল্ডিং পরিদর্শন শেষে সামনের চতুর্ভুজ আকৃতির সুন্দর খেলার মাঠের উত্তর থেকে দক্ষিণে হাটছি আমরা। কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্লাস শেষে ফুটবল নিয়ে মাঠে অগোছালেভাবে দৌড়াচ্ছিল। মাঠে তার উপস্থিতি টের পেয়ে সকল শিক্ষার্থীরা একটু বিরতি নিয়ে নিলো। এরই মাঝে দাপ্তরিক কিছু কাগজে জরুরি সিগনেচারের প্রয়োজন হওয়ায় মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেগুলো সই করে দিলেন। অফিসিয়াল নথি নিয়ে আসা ছেলেটার পিঠে রেখেই সেসব নথিতে সই করলেন তিনি। কারন জানতে চাইলে তিনি বললেন, অফিস ছুটি হতে অল্প সময় বাকি। অফিস স্টাফ ছেলেটিকে আটকে না রেখে ছেড়ে দেওয়ার জন্যই তার এই পন্থা। পিয়নের প্রস্থানের পর আবারো শুরু হলো গল্প।

শীতের শেষ বিকেলের মিস্টি রোদে মাঠে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট কথা বলা শেষে তিনি আবারো হাটা শুরু করলেন মাঠের দক্ষিণ দিকে। এবার গন্তব্য ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জুট ল্যাবের একটি পুরাতন মেশিন সচল কার্যক্রম পরিদর্শন করা। সেখানে আগে থেকে ল্যাবের টেকনিক্যাল অফিসারেরা কাজ করছিলেন। আমাদের দেখে তারাও কাজে একটু বেশি মনোযোগী হলেন। গল্প বাদ দিয়ে হঠাৎ করে অধ্যাপক বেলাল সুতার বুনন ধরে আনমনা হয়ে গেলেন। মনে হলো যেন তিনি পুরোনো কোনো স্মৃতি রোমান্থন করছেন। তাৎক্ষণিক টেকনিক্যাল অফিসারদের কিছু ভুল শুধরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন বুটেক্স ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের পাদদেশে।

সেখানে আগে থেকেই সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশের নামকরা এক টেক্সটাইল মিলে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেওয়া এক শিক্ষার্থী অপেক্ষায় ছিলেন মিস্টি হাতে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে এসেছেন প্রিয় শিক্ষককে মিস্টিমুখ করাতে। সে মিস্টি আমরাও খেলাম। ছেলেটি বিদায় নেওয়ার পর বেশ গর্বের সুরেই অধ্যাপক বেলাল আমাদের জানালেন, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ‍্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র টেক্সটাইল বিশ^বিদ্যালয়ই শতভাগ কর্মমূখী বিশ‍্ববিদ্যালয়। এখানে প্রতিবছর মাত্র ৬শ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকুরির জন্য একটি দিনও অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে না বুটেক্স শিক্ষার্থীদের। কারণ দেশে এবং দেশের বাইরে টেক্সটাইল প্রকৌশলীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে যোগ করেন তিনি। চাহিদার তুলনায় তারা টেক্সটাইল মিলে পর্যাপ্ত প্রকৌশলীদের পাঠাতে পারেন না বলে অনুযোগ মনে হলে তার কন্ঠে।

মিস্টি খাওয়া শেষ করে জানতে চাইলাম টেক্সটাইল সেক্টরে বাংলাদেশ কি শুধু তৈরি পোশাক খাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না কি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে? কিছুটা গুরু গম্ভীর হয়ে মাথা তুলে বললেন, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব জায়গায় টেক্সাটাইলের ব্যবহার আছে। প্রাচীন গুহা সভ্যতার পর আধুনিক সভ্যতায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্ত মানুষ টেক্সটাইলকে ব্যবহার করছে।

উন্নত বিশ‍্ব টেক্সটাইলকে গবেষণার মাধ্যমে অপারেশনের টেবিলে, রাস্তা ও ব্রিজ তৈরিতে, অস্ত্র ও গাড়ীতে, বাড়ি তৈরিতে, রকেট, এমনকি বিমানেও টেক্সটাইলের সংযোজন বাড়িয়েছে বহুগুন। সেখানে বাংলাদেশ এখনও গায়ে জড়ানো পোশাক তৈরি করেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে মাত্র। বাংলাদেশের পাট, নারকেলের ছোবলা এবং কলা গাছের খোলা থেকে উন্নতমানের ফাইবার ও সুতা তৈরি সম্ভব বলে মনে করেন ড. আলিমুজ্জামান। যা দিয়ে টেক্সটাইল শিল্পে নবদিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

তবে এ ক্ষেত্রে গবেষণা এবং গবেষণার পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এসব গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লে নিবীড় গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প আরো বহুদুর এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন সম্প্রতি ‘সেলাই বিহীন পাটের ব্যাগের পেটেন্ট’ অর্জনকারী গবেষক অধ্যাপক ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান।

কাপড়ের সুতা তৈরির কাঁচামাল তুলার জেলা হিসেবে বিখ্যাত যশোরে বেড়ে ওঠার কারনেই কি টেক্সটাইল বা ফেব্রিকের প্রতি এত বেশি প্রেম? জানতে চাইলে কিছুটা মৃদু হেসে বলেন, তাদের ছোটবেলায় যৌথ পরিবারে বসবাসের কারনে নিজেদের শার্টের সামান্য বোতাম সেলাইয়ের কাজও নিজেদেরই করে নিতে হতো। তাছাড়া মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক জীবনে যশোরের বিখ্যাত এনজিও ‘বাঁচতে শেখা’র বিশাল ক্যাম্পাসে তুলা ও রেশম চাষ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ঐ এলাকার অনেক বাড়িতেও তখন রেশম পোকার চাষ হতো। কিভাবে পোকা থেকে সুতা হয় এবং তা মানুষের ব্যবহারের উপযোগী হয় এটা অনেকের কাছে শুধুমাত্র কৌতুহলের বিষয় থাকলেও যশোর জেলা স্কুলের মেধাবী ছাত্র বেলাল সেটাকে দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর পর ‘মসলিন পুনরুদ্ধার’ মিশনে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ‘একজন আপদমস্তক টেক্সটাইলম্যান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ড. আলিমুজ্জামান শুধু যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া, দাপ্তরিক কাজ করা, পরীক্ষাপত্র মূল্যায়ন করা বা গবেষণার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন তা নয়। বরং শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষকতা জীবনের প্রতিটি জায়গায় তিনি নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেস্টা করেছেন। ১৯৯২ সালে গ্রাজুয়েশন শেষে পিএসসির মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে শিক্ষক হিসেবে বুটেক্সে যোগদান করেন। শুরুতে হল প্রভোস্টের দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি বিশ‍্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন একমাত্র হল শহীদ আজিজ হলের খাবারের মান উন্নত করার দিকে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। কিছু নতুন কৌশল অবলম্বন করে সফলও হয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের হল ডাইনিংয়ে সকালের নাস্তার প্রচলন টেক্সটাইল বিশ‍্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম করেছিলেন। এরপর একে একে বিশ‍্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার, বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষার্থী কল্যান পরিচালক, অধিভুক্ত কলেজসমুহের ইন্সপেক্টর, প্রক্টর এবং পরবর্তীতে একাধিকবার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ডীন ও রেজিস্ট্রার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ সুনামের সাথে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে সচ্ছতার সাথেই অনুষ্ঠান উৎযাপন করে সুনামও কুড়িয়েছেন পুরো ক্যাম্পাসে। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে বুটেক্সের প্রগতিশীল শিক্ষক সমিতির ব্যানারে নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

এতসব দায়িত্ব পালন করে পরিবার এবং সন্তানদের দেখভাল করার সময় পান কি না জানতে চাইলে চোখে সুরমা পরা কালো চোখের নীচে আলতো হাসি দিয়ে বললেন, সন্তান এবং সংসার সামলান তার স্ত্রী। তবে সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে তিন কন্যার মা অর্থ্যাৎ তার স্ত্রীকে সার্বিক সহযোগিতা তিনি করে আসছেন শুরু থেকেই। তিন কন্যার বাবা ড. বেলাল। তিনজনই ঢাকার ভিকারুনন্নেসা স্কুলের শিক্ষার্থী। একজন এমবিবিএস পাশ করে ডাক্তার পেশায় যুক্ত হয়েছেন। একজন ডাক্তারী পড়াশুনা করছেন। আর অন্যজন এখন ঐ স্কুলে অধ্যায়নরত। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজ সন্তানদের চেহারা দেখার চেস্টায় সকাল থেকে সন্ধ্যা, কখনো গভীর রাত পর্যন্ত বুটেক্স ক্যাম্পাসেই কেটে যায় এই টেক্সটাইল প্রকৌশলীর সময়। কখনো ক্লাস, কখনো পুরোনো জং ধরা মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতি রোমান্থন, কখনো শিক্ষক কমনরুমে সহকর্মীদের সাথে চায়ের আড্ডায় খুজে পান জীবনের সত্যিকারের উপলব্ধি।

সূত্র: ভোরের ডাক

 

শেয়ার করুন

1 thought on “মসলিন পুনরুদ্ধরের নেতৃত্ব দেওয়া ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালের গল্প

Comments are closed.