বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী হিসেবে টিকে থাকার এবং নিজেদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করার সব রকম সম্ভাবনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের রয়েছে।
আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং ফার্ম ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি ‘এক দশকের উন্নতির পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের আগামীর ভবিষ্যৎ কী?’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। এখানে বলা হয়েছে, মহামারি সংকট দেশের পোশাক শিল্পকে অন্তিম মুহূর্তে এসে থামিয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে বিশ্ববাজারে ফ্যাশনের উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসায় তা পণ্য সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাশন পোর্টাল ‘জাস্ট-স্টাইল’ আচিম বার্গ, হর্ষ ছাপারিয়া, সাসকিয়া হেডরিক ও কার্ল-হেনড্রিক ম্যাগনাস প্রমুখ লেখকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, বাংলাদেশে পোশাক শিল্প খাতকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে হলে এখন এই খাতে স্থিতিস্থাপকতা, টেকসই ধারণক্ষমতা, শ্রমিক উন্নয়ন ও অবকাঠামোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরিবেশবান্ধব কারখানা প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, ‘সোর্সিং মডেল পরিবর্তন হওয়ায় পোশাক শিল্পে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য কোনো হুমকি নয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা এই চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে অবগত আছেন। তবে আমি মনে করি আমাদের এই ইস্যুকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের একটি বড় রকমের সুবিধা থাকার কারণ, এই খাতে বেশকিছু পরিবেশবান্ধব ফ্যাক্টরি রয়েছে এবং এগুলো পরিবেশগত ও সামাজিক প্রতিপালনকে লক্ষ্য হিসেবে রেখেছে যা অন্য দেশগুলো এখনো করেনি, জানালেন হক। তিনি বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতিও।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি রিপোর্টে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো জয় করতে পারি, তাহলে এগুলোই আমাদের সামনে সুযোগ সুবিধা হিসেবে আসবে। আমরা এখান থেকে কতটা সুবিধা আদায় করতে পারব, সেটি আমাদের ওপরই নির্ভর করছে। এর পাশাপাশি, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এবং আমাদের মনোভাবেরও কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে।’
‘কোভিড-১৯ সংকট আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং কীভাবে এই নিউ নরমালের সঙ্গে মানিয়ে চলব, তা নিয়েও বিভিন্ন পরিবর্তন এনেছি আমরা। উদাহরণস্বরূপ, আমরা আমাদের উৎপাদন কাজ চালানোর সময় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি’, বলেন হক।
রিপোর্টে বাংলাদেশের বিগত এক দশকের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে হক বলেন, ‘তবে একইসঙ্গে আমরা এমন কিছু সুযোগও এড়িয়ে গিয়েছি, যা বাংলাদেশকে আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারত।’
এক দশকে পোশাক শিল্পখাতে যত উন্নতি
দশ বছর আগে ম্যাককিনসে এই খাতে উন্নতির পরিমাণ জানিয়েছিল ৭-৯ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১১ সালে যেখানে ছিল ১৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৯ সালে এসে তা ৩৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ফলে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে।
এই সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পের শেয়ার বেড়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
গবেষণার লেখকেরা বলেন, ‘আমাদের রিপোর্টে যে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম, এটা সেই পরিসরের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার শতভাগ উন্নতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে হয়নি।’
মহামারির কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা দুটিই প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বহু ছোটখাট কারখানা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে এবং ছোট ছোট অর্ডার নিয়ে প্রতিযোগিতার হার বেড়ে গিয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হয়।
রিপোর্ট অনুযায়ী, মহামারির প্রথম বছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি ১৭ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এর ফলে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রাজস্ব আয়ের ক্ষতি হয়।
উন্নয়ন বনাম চ্যালেঞ্জ
ক্ষতির কথা উল্লেখ থাকলেও রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ বিগত এক দশকে তৈরি পোশাক শিল্পে ‘উল্লেখযোগ্য উন্নতি’ করেছে এবং নানামুখী চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বিশেষ করে ক্রেতা ও পণ্যের বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে, সরবরাহকারী ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নে এবং টেকসই মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ ভালো কর্মক্ষমতা দেখিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশে কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করে পোশাক তৈরির পরিমাণ অনেক বেশি। এছাড়াও দেশে এখন বহিঃস্থ পোশাক, সেলাই করা পোশাক আইটেম, অন্তর্বাসের মতো অপেক্ষাকৃত জটিল পণ্যগুলোও তৈরি হয় এবং বেশ ভালোমানের প্রিন্ট ও লেজার ফিনিশিংও দেওয়া হয় এসব পণ্যে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে এসব নতুন ধরনের পণ্য তৈরির জন্য তাদের সাহায্যে বাইরের দেশগুলো থেকে আমদানিকৃত কাপড় এই কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। সরবরাহ চেইনের শীর্ষস্থ একীকরণেও কিছুটা বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে এবং এর ফলে অনেক সরবরাহকারী এখন ৯০ দিনের কম সময় দেওয়ার প্রস্তাব রাখতে পারবেন।
ম্যাককিনসে জানায়, অনেক বাংলাদেশি কারখানা এখনো পর্যন্ত এসব সুযোগ সুবিধা পায়নি এবং এর জন্যে যতখানি বিনিয়োগ করতে হয়, তা করা থেকে বিরত থেকেছে। রিপোর্টে দেখানো হয়, টি-শার্ট, ট্রাউজার, সোয়েটারই এখনো দেশের রপ্তানি বাজারে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে।
এই খাতে দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জটি হলো কর্মীদের ক্ষমতায়ন ও লৈঙ্গিক বৈষম্য। মজুরি দেওয়া বৃদ্ধি পেলেও কর্মী অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ফাঁক রয়ে গিয়েছে।
যদিও প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ক্যারিয়ারে অগ্রগতির দিক থেকে লৈঙ্গিক অসমতার বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম ইস্যু হলো অবকাঠামো। ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পে অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশকে পরিবহণ, শক্তি ও অবকাঠামোর ডিজিটাইজেশন করতে হবে বলে জানায় ম্যাককিনসে।
চ্যালেঞ্জ নিয়েই উঠে দাঁড়ানো
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী হিসেবে টিকে থাকার এবং নিজেদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করার সব রকম সম্ভাবনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের রয়েছে। যদিও এই মুহূর্তে দেশের পোশাক খাতে নানা ঝড়ঝাপ্টা আসছে; তবে এই খাতের শীর্ষস্থান ধরে রাখতে হলে চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হবে কর্তৃপক্ষকে, জানায় ম্যাককিনসের রিপোর্ট।
ম্যাককিনসে আরও জানায়, পক্ষপাতদুষ্ট বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই হবে। আর এর জন্য গতানুগতিক ক্রেতা বাজারের কমে যাওয়া চাহিদা পূরণ করতে হবে এবং আরও চাহিদানির্ভর টেকসই সোর্সিং মডেল খোঁজার দিকে ঝুঁকতে হবে।
জাস্ট-স্টাইল কিছু আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, তারা মনে করেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখনো যথেষ্ট গতিশীল নয়। তবে বাকিরা তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক চিন্তা করেছেন এবং তারা মনে করেন, বাংলাদেশের উৎপাদনকারীরা ইতিপূর্বে যেই স্থিতিস্থাপকতা ও অভিযোজন-প্রবণতা দেখিয়েছেন, তা থেকে প্রত্যাশা করা যায়, দেশটির তৈরি পোশাক শিল্প প্রয়োজনমতো রূপান্তরিত হতে সক্ষম, যদিও কাঠামোগত পরিবর্তন এখানে অসম্ভব।
কিছু সোর্সিং এক্সিকিউটিভ বাংলাদেশে বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দিকে সোর্সিং ভলিউমের পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে বেশি যৌগিক ও প্রযুক্তিগত পণ্য ও কৃত্রিম জিনিসের ক্ষেত্রে। তারা এমন সব সরবরাহকারী খুঁজছেন, যারা টেকসই ধারণক্ষমতাসম্পন্ন, কর্মীবান্ধব ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে বিনিয়োগ করে।
রিপোর্টে পরামর্শ দেওয়া হয়, বাংলাদেশ সরকার যদি এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে, তাহলে তা দেশের জন্য উপকারি হতে পারে।
নানামুখী বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই বিগত এক দশক ধরে চমকপ্রদ উন্নতি করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প। বর্তমানে মহামারি সংকটের মধ্যে বিভিন্ন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে পোশাক শিল্প খাত। আগামী বছরগুলোকে সামনে রেখে এই খাতের উচিত উৎপাদনকারী, আন্তর্জাতিক ক্রেতা, কর্ম প্রতিনিধি, সরকার ও শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে অংশীদার হয়ে সামগ্রিক রূপান্তর অনুসরণ করা।
ম্যাককিনসের রিপোর্টের শেষে বলা হয়, ‘যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্রেতারা দ্রুত পরিবর্তনশীল রূপে কাজ করে, তাই তারা আরও আধুনিক ও উন্নত সরবরাহকারীদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। আর এজন্য তাদের আরও গভীর ও বাস্তবিক কৌশলী অংশীদারিত্ব তৈরি করতে হবে এবং বৈশ্বিক খুচরা বাজারের বিগত দশকের সঙ্কুচিত গতিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে।’
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড